সংগঠন > পরিচিতি

হালনাগাদ: ৪ পৌষ ১৪৩০/ ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলা ১৩৬৮, ইংরেজি ১৯৬১ সালে সারাবিশ্বে রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর আয়োজন বাংলার এই প্রান্তের সংস্কৃতিসচেতন মানুষের মনেও চাঞ্চল্য জাগায়। উদ্‌যাপনের ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানি শাসনের থমথমে পরিবেশেও কিছু বাঙালি একত্র হন আপন সংস্কৃতির মধ্যমণি রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষপূর্তির উৎসব করবার জন্যে। উদ্যোগী হলেন বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, ডক্টর গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বুদ্ধিজীবী, তেমনি ঢাকার কিছু সংস্কৃতিকর্মীও আগুয়ান হলো শতবর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্যে। অগ্রাহ্য হলো অনতিউচ্চারিত নিষেধ। সংস্কৃতি-প্রাণ মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর সফল উদ্যোগ। শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করবার পর এক বনভোজনে গিয়ে সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকের ‘ভীমরুল’), ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সন্‌জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ বহু অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। জন্ম হয় ছায়ানটের। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে।
শুরুতে সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই বাঙালির সংস্কৃতি সাধনার সমগ্রতাকে বরণ ও বিকশিত করতে উদ্যোগী হয় ছায়ানট। সঙ্গীত শিক্ষাদান কার্যক্রমের সুবাদে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান গুণী শিল্পীরা সমবেত হন ছায়ানটে, পরম্পরাক্রমে তাঁরা বিকশিত করতে থাকেন অগণিত নবীন প্রতিভা। বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিরূপ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে ছায়ানট পরিবেশিত অনুষ্ঠানমালা জাতির প্রাণে জাগায় নতুন উদ্দীপনা, সঙ্গীত-সংস্কৃতির চর্চা-সূত্রে জাতিসত্তার চেতনা বলবান হতে থাকে। ছায়ানটের উদ্যোগে শৈল্পিক ও মননশীল মেধার সম্মিলন ও অনুশীলন জাতিকে যোগায় বিকাশের বিবিধ অবলম্বন। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদ-কর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধনে ছায়ানট পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা। সৃজনের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়েছিল ছায়ানটের প্রতিরোধী ও সর্বপ্লাবী সংস্কৃতি-সাধনা। বাংলা নববর্ষের প্রভাতী সঙ্গীতায়োজনের সুবাদে ছায়ানট বাঙালিত্বকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে স্বভূমিতে, স্বদেশের মুক্তি আন্দোলনে যা হয়ে ওঠে প্রেরণাদায়ক।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছায়ানট বাঙালির সার্বিক সংস্কৃতি চেতনাকে আরো ব্যাপক এবং নিবিড়ভাবে ধারণ করার তাগিদ অনুভব করে নিজস্ব ভবনে সেই প্রচেষ্টা অধিকতর ফলবান ও সার্থক করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন ঘিরে শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সমাজঅধ্যয়ন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে চলছে চর্চা ও কর্ষণ। সমাজের ভেতরকার সুপ্ত শক্তি বিকাশে ছায়ানট হবে সহায়ক, চিন্তার দিগন্ত প্রসারে হবে প্রেরণাসঞ্চারী- এই লক্ষ্য থেকেই সূচিত হয়েছে সংগঠনের বিবিধ কর্মধারা।
ছায়ানট সব দুর্যোগ দুর্বিপাকে জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাজটি ছায়ানটের দায় এবং ঐতিহ্যগত। ষাটের দশকের আরম্ভে দেশের দক্ষিণোপকূলে গোর্কি আঘাত হানার পর কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়া উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল ছায়ানট। গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষামিছিল করে পথচারী, রিকশাচালক, মায় ভিখারিদের কাছ থেকে পাঁচ পয়সা দশ পয়সা করে নিয়েও জমেছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে সংগ্রহের অনেকাংশ দুর্যোগকালের আশ্রয়স্থল এবং দুটি বিদ্যালয় ভবন উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাস, উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এবং পরবর্তীকালে দেশ যতবারই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত হয়েছে ততবারই ত্রাণ নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এ সংগঠন।